২২ বছরের অভিজ্ঞ ট্রেনচালক মো. আবদুর রহমান। জীবনের সবচেয়ে বিব্রতকর ঘটনার মুখোমুখি হয়েছেন ‘প্রকৃতির ডাকে’ সাড়া দিতে গিয়ে। ব্রাহ্মণবাড়িয়া স্টেশনে ট্রেন থামিয়ে শৌচাগারে যাওয়ার কারণে তার ও সহকারী লোকোমাস্টার কাওছার আহম্মেদের বিরুদ্ধে বাংলাদেশ রেলওয়ে কর্তৃপক্ষ কন্ট্রোল অর্ডার (তলব) জারি করে।
ঘটনার পর সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে বিষয়টি ভাইরাল হলে এবং গণমাধ্যমে সংবাদ প্রকাশ হলে কর্তৃপক্ষ পরে মৌখিকভাবে সেই আদেশ প্রত্যাহার করে।
তবে কর্তৃপক্ষ পরে মৌখিকভাবে অর্ডারটি বাতিল করেছে। এর আগেই বিষয়টি সামাজিক যোগাযোগমাধ্যম ফেসবুকে ছড়িয়ে পড়ে। কোনো কোনো গণমাধ্যম এ নিয়ে প্রতিবেদনও প্রকাশ করেছে। আবদুর রহমান বলেন, ‘আমার স্ত্রী আর দশম শ্রেণিতে পড়া মেয়ে বিষয়টি নিয়ে খুবই মন খারাপ করেছে। অষ্টম শ্রেণিতে পড়া ছেলে শুধু হাসে। বিষয়টি এত বিব্রতকর যে কাউকে বলাও যায় না।’
ঘটনার পেছনের কারণ কী ছিল?
গত ১৭ মে সকাল সাড়ে ছয়টায় ঢাকা রেলওয়ে স্টেশন থেকে সিলেটের উদ্দেশে ছেড়ে যায় আন্তনগর ট্রেন পারাবত এক্সপ্রেস। ট্রেন চালাচ্ছিলেন আবদুর রহমান ও মো. কাওছার আহম্মেদ।
ঘটনার বিবরণে চালক আবদুর রহমান বলেন, ব্রাহ্মণবাড়িয়া স্টেশনে ট্রেনটির তিন মিনিটের যাত্রাবিরতি ছিল সেখানে। ওই স্টেশনে ট্রেন পোঁছায় সকাল ৮টা ৪৪ মিনিটে। তিনি বলেন, ‘ইঞ্জিনে টয়লেট নেই। প্রস্রাবের চাপ সামলাতে না পারলে মাঝেমধ্যে মোটা পলিথিন বা বোতলে সে কাজটি করতে হয়। কিন্তু পায়খানা ধরলে তো কিছু করার থাকে না। সেদিন ট্রেন থামার পর নেমে প্রথমে ইঞ্জিনের পেছনে গার্ডের রুমে যাই। সেখানে টয়লেটে তালা মারা দেখে ট্রেন থেকে নেমে স্টেশনমাস্টারের কক্ষের টয়লেটে যাই। বিষয়টি ঢাকা কন্ট্রোলেও জানিয়েছি।’
আবদুর রহমান বলেন, স্টেশনমাস্টার ততক্ষণে পারাবত ট্রেনের সিগন্যাল দিয়েছেন। পরে তা বাতিল করে পেছনে থাকা চট্টগ্রামগামী ননস্টপ আন্তনগর ট্রেন সোনার বাংলা এক্সপ্রেসকে আগে যাওয়ার জন্য সিগন্যাল দেওয়া হয়। এতে প্রায় ১৬ মিনিট চলে যায়। তিনি আরও বলেন, ‘ওয়াশরুমে যাওয়া-আসাসহ মোট ছয় মিনিট সময় লাগে। সোনার বাংলা এক্সপ্রেসকে অগ্রাধিকার দেওয়া ও ওয়াশরুম ব্যবহারে ৩ মিনিট বিরতির সময়সহ মোট ২১ মিনিট সময় লাগে। গার্ড প্রকৃতির ডাক উল্লেখ করে ডিটেনশন বইয়ে ২১ মিনিট ব্যয়ের কথা লিখেছেন। আলাদা করে কোন কাজে কত সময় লেগেছে তা উল্লেখ করেননি।’
আবদুর রহমান জানান, ‘ইঞ্জিনে টয়লেট না থাকায় প্রতিবার ডিউটির আগে পানি কম খেতে হয়। খাবারও বেছে খেতে হয়। ৯৯% চালকের ইউরিন ইনফেকশনসহ নানা শারীরিক সমস্যা হয়।’
এ ঘটনাকে উল্লেখ করে সহকারী লোকোমাস্টার কাওছার আহম্মেদ ফেসবুকে সরব হন। তাঁর পোস্টে অনেকেই ক্ষোভ প্রকাশ করেন—‘চালকেরা কি রোবট?’ এমন প্রশ্নও উঠে আসে।
রেল ইউনিয়নের বক্তব্য
বাংলাদেশ রেলওয়ে রানিং স্টাফ ও শ্রমিক কর্মচারী ইউনিয়নের সাধারণ সম্পাদক মো. মজিবুর রহমান বলেন, ‘টয়লেট না থাকায় ট্রেনচালকরা অনেকসময় প্রচণ্ড অস্বস্তিতে পড়েন, যা ট্রেন চালানোর মনোযোগে প্রভাব ফেলে। এতে দুর্ঘটনার ঝুঁকিও বাড়ে।’
তিনি আরও জানান, টয়লেটের দায়িত্ব কে নেবে—এ অজুহাতে বিষয়টি বারবার এড়িয়ে যায় রেল কর্তৃপক্ষ। নতুন ইঞ্জিন কেনার সময় চালকদের মতামত নেওয়া হয় না বলেও অভিযোগ করেন তিনি।
দেশের প্রথম নারী ট্রেনচালক ছালমা খাতুন বলেন, ‘টয়লেট না থাকায় আমাদের দূরের গন্তব্যে পাঠানো হয় না। ইঞ্জিনে বসে গরমে কাজ করতে হয়, পানি কম খেতে হয়। প্রস্রাব চেপে রাখায় শারীরিক সমস্যা হয়।’
সমাধানের আশ্বাস
রেলওয়ে ঢাকা বিভাগের ব্যবস্থাপক মোহাম্মদ মহিউদ্দিন আরিফ চালকদের সঙ্গে বৈঠক করেছেন। তিনি আশ্বাস দিয়েছেন, টয়লেট সমস্যার সমাধানে ঊর্ধ্বতনদের সঙ্গে আলোচনা হবে। কিন্তু বাস্তবতা হলো—৩ হাজার সিরিজের ৩০টি ইঞ্জিনে টয়লেটের জায়গা থাকলেও তা বাস্তবায়ন হয়নি। চালকেরা ক্ষোভের সঙ্গে বলেন, ‘সুইচবোর্ডে শুধু ‘টয়লেট’ লেখা আছে, বাস্তবে কিছুই নেই।’
পরিশেষে প্রশ্ন থেকে যায়... চালকদের এমন পরিস্থিতিতে রেখে যদি দুর্ঘটনা ঘটে, দায় কার?