ঢাকা ও চট্টগ্রামে একই দিনে, একই সময়ে এক ব্যক্তির গুলিবিদ্ধ হওয়ার ঘটনায় দায়ের হওয়া দুটি মামলাকে কেন্দ্র করে শুরু হয়েছে জোর আলোচনা। আলিয়া মাদ্রাসার শিক্ষার্থী সাইফুদ্দীন মুহাম্মদ এমদাদের চোখে গুলিবিদ্ধ হওয়ার অভিযোগে করা দুটি মামলার এজাহারে সময় ও স্থানের বড় ধরনের অসঙ্গতি থাকায় বিষয়টি এখন আইনি বিতর্কে রূপ নিয়েছে।
দুই মামলার তথ্য বিশ্লেষণ করলে দেখা যায়, গত বছরের ৪ আগস্ট ছাত্র আন্দোলনের সময় সাইফুদ্দীন ঢাকার পরীবাগ এবং চট্টগ্রামের নিউমার্কেট মোড়ে গুলিবিদ্ধ হয়েছেন বলে দাবি করা হয়।
ঢাকার শাহবাগ থানায় আদালতের আদেশে নেওয়া মামলার এজাহারে বলা হয়েছে, ২০২৪ সালের ৪ আগস্ট সকাল সাড়ে ১১টায় পরীবাগে ছাত্র-জনতার মিছিলে সাইফুদ্দীন চোখে গুলিবিদ্ধ হন। মামলাটির বাদী মানবাধিকার সংগঠনের নেতা ও ছাত্রদলের সাবেক সহ-সভাপতি এম এ হাশেম রাজু, যিনি নিজেকে ঘটনার প্রত্যক্ষদর্শী হিসেবে দাবি করেছেন।
এ মামলায় চলতি বছরের ২০ মার্চ পলাতক সাবেক প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা, অভিনেত্রী মেহের আফরোজ শাওন, জায়েদ খানসহ ২০১ জনকে আসামি করা হয়।
অন্যদিকে, চট্টগ্রামের খুলশী থানায় ১৭ জুন দায়ের করা মামলার বাদী সাইফুদ্দীন নিজেই। সেখানে তিনি উল্লেখ করেন, ৪ আগস্ট সকাল ১১টায় চট্টগ্রামের নিউমার্কেট মোড়ে আন্দোলনে অংশ নিয়ে গুলিবিদ্ধ হন এবং পরদিন ৫ আগস্ট ওয়াসা মোড়ে দ্বিতীয়বার গুলিবিদ্ধ হন। এই মামলায় সাবেক প্রধানমন্ত্রীসহ ১৬৭ জনকে আসামি করা হয়েছে।
শাহবাগ থানার ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তা (ওসি) মোহাম্মদ খালিদ মনসুর বলেন, “আদালত আমাদের কাছে ভুক্তভোগীর মেডিকেল সার্টিফিকেট চেয়েছে। তার সঙ্গে যোগাযোগ করেও তা সংগ্রহ করা সম্ভব হয়নি। আদালতকে বিষয়টি জানিয়ে তদন্ত প্রতিবেদন দাখিলের জন্য আরও এক মাস সময় চাওয়া হয়েছে।”
তিনি আরও বলেন, চট্টগ্রামে একই বিষয়ে আরেকটি মামলা হয়েছে তা তারা শুনেছেন এবং প্রয়োজনে আদালতকে বিষয়টি জানানো হবে।
এদিকে খুলশী থানার ওসি আফতাব হোসেন জানান, ঢাকায় এ বিষয়ে মামলা রয়েছে তা তাদের জানা ছিল না। তিনি বলেন, “ভুক্তভোগী নিজে এসে মামলা করেছেন। অন্য কোথাও মামলা হয়েছে তা জানা ছিল না। আর ঢাকার মামলায় ভুক্তভোগী বাদী নন। তবে একই সময় দুই শহরে গুলিবিদ্ধ হওয়ার দাবি অবিশ্বাস্য। তদন্তেই সব সত্য বের হয়ে আসবে।”
চট্টগ্রাম মেট্রোপলিটন পুলিশ কমিশনার হাসিব আজিজ বলেন, “ঢাকায় মামলা হয়ে থাকলে চট্টগ্রামের মামলার বিষয়টি যাচাই করে প্রয়োজনীয় পদক্ষেপ নেওয়া হবে।”
সময় ও স্থানের অসংগতি ঘিরে জটিলতা
আইনজীবীদের মতে, একই ব্যক্তি একসাথে দুই শহরে গুলিবিদ্ধ হন— এমন দাবি বাস্তবসম্মত নয়। চট্টগ্রামের এজাহারে বলা হয়েছে, সাইফুদ্দীন ১ আগস্ট থেকে ৮ আগস্ট পর্যন্ত চট্টগ্রামেই অবস্থান করেছেন। সেক্ষেত্রে ৪ আগস্ট ঢাকার পরীবাগে তিনি কীভাবে গুলিবিদ্ধ হলেন— এ প্রশ্ন উঠেছে।
এ বিষয়ে ঢাকার মামলার বাদী হাশেম রাজু গণমাধ্যমকে বলেন, “আমি নিজেই পরীবাগে তাকে গুলিবিদ্ধ হতে দেখেছি এবং সেদিন রাতেই চট্টগ্রামে পাঠিয়েছি।”
তবে চট্টগ্রামের মামলায় সাইফুদ্দীন নিজেই বলেছেন, তিনি ১ আগস্ট থেকেই চট্টগ্রামে অবস্থান করছিলেন এবং নিউমার্কেট মোড়ে গুলিবিদ্ধ হন।
এই দুই মামলার বাস্তবতা যাচাইয়ে এখন গুরুত্বপূর্ণ হয়ে উঠেছে ভুক্তভোগীর মোবাইল ফোনের লোকেশন ডেটা, হাসপাতালের চিকিৎসা নথি ও মেডিকেল প্রতিবেদন। এখনও পর্যন্ত শাহবাগ থানা মেডিকেল সার্টিফিকেট সংগ্রহ করতে পারেনি।
আইনের চোখে বিষয়টি
আইন বিশেষজ্ঞরা বলছেন, দুই মামলায় সময় ও ঘটনার স্থান নিয়ে এমন অসামঞ্জস্য ফৌজদারি আইনের গুরুতর ব্যত্যয়।
-
দণ্ডবিধির ২১১ ধারা অনুযায়ী, মিথ্যা মামলা দায়ের করলে ২ থেকে ৭ বছর পর্যন্ত কারাদণ্ড বা জরিমানা অথবা উভয় দণ্ড হতে পারে।
-
ফৌজদারি কার্যবিধির ১৮২ ধারা অনুযায়ী, সরকারি কর্তৃপক্ষকে মিথ্যা তথ্য দেওয়া শাস্তিযোগ্য অপরাধ।
বাংলাদেশ হিউম্যান রাইটস ফাউন্ডেশনের মহাসচিব অ্যাডভোকেট জিয়া হাবিব আহসান বলেন, “একই সময়ে ভিন্ন স্থানে গুলিবিদ্ধ হওয়ার দাবি বাস্তব ও আইনের পরিপন্থী। এটি কোনো বিভ্রান্তি নয়, ইচ্ছাকৃত কাজ— যা দণ্ডনীয় অপরাধ।”
রাজনৈতিক ইন্ধন?
এই দুটি মামলা রাজনৈতিক উদ্দেশ্যপ্রসূত কি না— সেই প্রশ্নও সামনে আসছে। ঢাকার মামলাটি করেছেন একজন রাজনৈতিক নেতা ও মানবাধিকার কর্মী, আর চট্টগ্রামের মামলার বাদী ভুক্তভোগী নিজেই। পাশাপাশি দুই মামলায় আলাদা ঠিকানা ব্যবহারের বিষয়টিও সন্দেহের জন্ম দিয়েছে।
সাইফুদ্দীন গণমাধ্যমকে বলেন, “আমি কাউকে হয়রানি করতে মামলা করিনি। তদন্তেই সত্য প্রমাণিত হবে।”
এর আগেও মোহাম্মদপুরে ছাত্র আন্দোলনে গুলিতে নিহত তরুণ ব্যবসায়ী রোকনের ঘটনায় এমন দ্বৈত মামলা হয়েছিল। আদালতের আদেশে সেখানে নিহতের পরিবারের করা মামলাটিকেই তদন্তের জন্য অগ্রাধিকার দেওয়া হয়েছিল।