মধ্যপ্রাচ্যে ইরান ও ইসরায়েলের চলমান উত্তেজনা আপাতত সীমিত মাত্রায় থাকলেও আন্তর্জাতিক পর্যবেক্ষকরা আশঙ্কা করছেন, সামান্য উত্তেজনা যদি দমন না হয়, তাহলে তা বিস্তৃত যুদ্ধ ও বৈশ্বিক সংকটে রূপ নিতে পারে। জাতিসংঘসহ বিভিন্ন আন্তর্জাতিক সংস্থা দুই পক্ষকে সংযত থাকার আহ্বান জানালেও আশঙ্কা থেকেই যাচ্ছে—যদি কোনো একপক্ষ সেই আহ্বান না শোনে, তাহলে কী হতে পারে?
নিচে সম্ভাব্য সবচেয়ে খারাপ পরিণতিগুলোর বিশ্লেষণ তুলে ধরা হলো:
১. যুক্তরাষ্ট্রের সরাসরি জড়িয়ে পড়া
ইরান মনে করে, যুক্তরাষ্ট্র নীরবে হলেও ইসরায়েলের সাম্প্রতিক হামলাকে সমর্থন করছে। সেই বিশ্বাস থেকে ইরান মধ্যপ্রাচ্যজুড়ে মার্কিন ঘাঁটিগুলোতে হামলা চালাতে পারে—বিশেষত ইরাকে মার্কিন বাহিনীর ঘাঁটি, উপসাগরীয় ঘাঁটি এবং কূটনৈতিক স্থাপনাগুলো লক্ষ্য হতে পারে।
যুক্তরাষ্ট্র ইতোমধ্যেই অঞ্চল থেকে কিছু কর্মী প্রত্যাহার করেছে এবং ইরানকে সম্ভাব্য প্রতিক্রিয়া সম্পর্কে হুঁশিয়ারি দিয়েছে। তবে যদি কোনো মার্কিন নাগরিক নিহত হন—বিশেষ করে তেল আভিভ বা অন্যান্য স্পর্শকাতর অঞ্চলে—তাহলে সাবেক প্রেসিডেন্ট ট্রাম্পের মতো নীতি নির্মাতারা সরাসরি হস্তক্ষেপ করতে পারেন।
২. যুদ্ধ দীর্ঘায়িত ও সর্বগ্রাসী হয়ে উঠা
ইরান যদি সরাসরি ইসরায়েলের সামরিক ঘাঁটি বা পারমাণবিক স্থাপনায় জবাব দিতে না পারে, তবে তারা উপসাগরীয় অঞ্চলের তুলনামূলক দুর্বল দেশগুলোর অবকাঠামো, তেলক্ষেত্র, ও সামরিক লক্ষ্যবস্তুতে আঘাত হানতে পারে। এসব দেশের অনেকগুলোতে মার্কিন ঘাঁটি রয়েছে, যারা আগে গোপনে ইসরায়েলকে সাহায্য করেছে বলে অভিযোগ রয়েছে।
২০১৯ সালে সৌদি তেলক্ষেত্রে এবং ২০২২ সালে আমিরাতে হুথিদের হামলার পরিণতি থেকেই বোঝা যায়—প্রক্সি হামলার সক্ষমতা তাদের রয়েছে।
৩. হরমুজ প্রণালী ও লোহিত সাগরে উত্তেজনা
ইরান যদি হরমুজ প্রণালী বন্ধ বা সীমিত করে দেয়, এবং হুথি বিদ্রোহীরা লোহিত সাগরে জাহাজ চলাচলে বাধা দেয়, তাহলে বিশ্বজুড়ে জ্বালানি সরবরাহে মারাত্মক প্রভাব পড়বে। এমনিতেই তেলের দাম ঊর্ধ্বমুখী। এই অবস্থায় পরিবহন রুট অবরুদ্ধ হলে বিশ্বজুড়ে মূল্যস্ফীতি আরও চরম আকার ধারণ করবে।
৪. পরমাণু অস্ত্র অর্জনের তাগিদ
বিশ্লেষকদের মতে, ইসরায়েলের সামরিক হামলার ফলে ইরানের শীর্ষ নেতৃত্ব যদি মনে করে পারমাণবিক সক্ষমতা অর্জনই একমাত্র আত্মরক্ষার পথ, তাহলে দেশটি দ্রুত পূর্ণমাত্রার অস্ত্র তৈরির দিকে এগিয়ে যেতে পারে। বর্তমানে ধারণা করা হয়, ইরানের হাতে ৪০০ কেজি সমৃদ্ধ ইউরেনিয়াম রয়েছে—যা ১০টি পারমাণবিক বোমা তৈরি করতে সক্ষম।
ইসরায়েল হয়তো কিছু বিজ্ঞানীকে হত্যা করতে পেরেছে, কিন্তু বিজ্ঞান, অভিজ্ঞতা ও অবকাঠামো ধ্বংস করা সম্ভব নয়।
৫. ইরানের সরকার পতন ও গৃহযুদ্ধের সম্ভাবনা
ইসরায়েলের দীর্ঘমেয়াদি লক্ষ্য যদি হয় ইরানের শাসনব্যবস্থা পরিবর্তন, এবং সেটি সফল হয়—তাহলে প্রশ্ন থেকে যায়, এরপর কী?
একটি পরাশক্তিধর রাষ্ট্রের পতনের পর কি সেখানে একটি স্থিতিশীল সরকার গঠন সম্ভব হবে? নাকি দেশটি লিবিয়া বা ইরাকের মতো গৃহযুদ্ধ ও চরমপন্থার নতুন চক্রে ঢুকে পড়বে?
অন্তর্নিহিত সাম্প্রদায়িক বিভাজন, রাজনৈতিক শূন্যতা এবং বিদেশি হস্তক্ষেপ ইরানে ভয়াবহ রকমের বিশৃঙ্খলা ডেকে আনতে পারে।
৬. বৈশ্বিক মন্দার ঝুঁকি
এতসবের ফাঁকে, যে বিষয়টি সরাসরি আমাদের দৈনন্দিন জীবনে প্রভাব ফেলবে তা হলো অর্থনৈতিক ধাক্কা। তেলের দাম বাড়লে তা পণ্য পরিবহন, খাদ্য উৎপাদন ও রপ্তানি, বৈদেশিক বাণিজ্যসহ সবক্ষেত্রেই নেতিবাচক প্রভাব ফেলবে। মূল্যস্ফীতি বাড়বে, দরিদ্র দেশগুলোয় জীবনযাত্রার ব্যয় আরও অসহনীয় হয়ে উঠবে।
বিশ্লেষকরা সতর্ক করছেন, এই অস্থিরতা থেকে সবচেয়ে বেশি লাভবান হবেন রাশিয়ার ভ্লাদিমির পুতিন, কারণ তেলের দাম বেড়ে গেলে ইউক্রেন যুদ্ধ চালাতে তার কোষাগারে অতিরিক্ত অর্থ প্রবাহিত হবে।
শেষ কথা: সংকট নিরসনে এখনো সময় আছে
সবচেয়ে খারাপ পরিস্থিতি এড়াতে দুই পক্ষকেই সংযম অবলম্বন করতে হবে। সমাধান যদি সামরিক নয়, কূটনৈতিক হয়, তবেই সম্ভব এই যুদ্ধপ্রবণ অঞ্চলকে রক্ষা করা। ইরান ও ইসরায়েল উভয়ের জন্যই এটি অস্তিত্বের প্রশ্ন—তবে বিশ্বশান্তি, মানবিক মূল্য এবং অর্থনৈতিক স্থিতিশীলতার জন্য এখনই সচেতন পদক্ষেপ নেওয়া জরুরি।