বাংলাদেশের ত্রয়োদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচন এমন এক রাজনৈতিক বাস্তবতায় অনুষ্ঠিত হতে যাচ্ছে, যেখানে ‘নির্বাচন’ শব্দটির অর্থ ও বিশ্বাসযোগ্যতা নতুন করে সংজ্ঞায়িত হওয়ার দাবি রাখে। গণঅভ্যুত্থানের মাধ্যমে দীর্ঘদিনের ক্ষমতাসীন সরকারের পতনের পর এই নির্বাচন শুধু ক্ষমতা হস্তান্তরের সাংবিধানিক প্রক্রিয়া নয়; এটি রাষ্ট্রের গণতান্ত্রিক সত্তা পুনরুদ্ধারের একটি অগ্নিপরীক্ষা।
গত দেড় দশকে অনুষ্ঠিত তিনটি জাতীয় সংসদ নির্বাচন নির্বাচন নামেই ছিল, বাস্তবে ছিল ক্ষমতা সংরক্ষণের আনুষ্ঠানিকতা। ভোটারদের অংশগ্রহণ ছিল প্রশ্নবিদ্ধ, বিরোধী দল কার্যত অনুপস্থিত ছিল এবং প্রশাসন ও আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর নিরপেক্ষতা নিয়ে গুরুতর অভিযোগ ছিল। এসব নির্বাচনের ফলে যে সংসদ গঠিত হয়েছে, তা জনগণের প্রতিনিধিত্বের বদলে ক্ষমতার একচেটিয়া কাঠামোকেই বৈধতা দিয়েছে। এই বাস্তবতায় ত্রয়োদশ নির্বাচনকে ঘিরে মানুষের প্রত্যাশা যেমন স্বাভাবিক, তেমনি অবিশ্বাসও গভীর।
এই প্রেক্ষাপটে নির্বাচন কমিশনের ঘোষিত তফসিল ও সংশোধিত গণপ্রতিনিধিত্ব আদেশ (আরপিও) বিশেষ গুরুত্ব বহন করে। প্রার্থী হওয়ার যোগ্যতা ও অযোগ্যতা নিয়ে যে বিধানগুলো পুনরুচ্চারিত ও সম্প্রসারিত হয়েছে, সেগুলো নতুন নয়। এগুলো সংবিধান ও আইনে আগেই ছিল। নতুন বিষয় হলো- এই বিধানগুলো কার্যকরভাবে প্রয়োগ করার সাহস ও সদিচ্ছা এবার আদৌ দেখা যাবে কি না।
সংবিধান বলছে, সংসদ নির্বাচনে প্রার্থী হতে হলে নাগরিক হতে হবে এবং বয়স কমপক্ষে ২৫ বছর হতে হবে। কিন্তু বাস্তবতা হলো, অতীতে এই ন্যূনতম শর্ত পূরণ করলেই বহু ব্যক্তি নির্বাচনের টিকিট পেয়েছেন, যদিও তারা ছিলেন ঋণখেলাপি, সরকারি সুযোগ-সুবিধার সুবিধাভোগী, দুর্নীতির অভিযোগে অভিযুক্ত কিংবা সরকারের সঙ্গে সরাসরি ব্যবসায়িক সম্পর্কে জড়িত। এসব প্রার্থী নির্বাচিত হয়ে সংসদকে জনগণের স্বার্থরক্ষার মঞ্চ নয়, বরং ব্যক্তিগত ও গোষ্ঠীগত স্বার্থ রক্ষার কেন্দ্রে পরিণত করেছেন।
আরপিওতে স্পষ্টভাবে বলা আছে- সরকারি লাভজনক পদে অধিষ্ঠিত ব্যক্তি, সরকারের সঙ্গে চুক্তিভিত্তিক নিয়োগপ্রাপ্ত ব্যক্তি বা সরকারি চাকরি থেকে সদ্য অবসরপ্রাপ্তরা নির্দিষ্ট সময় না পার হলে প্রার্থী হতে পারবেন না। উদ্দেশ্য পরিষ্কার: প্রশাসনিক ক্ষমতা ও রাজনৈতিক ক্ষমতার মিশ্রণ ঠেকানো। প্রশ্ন হলো, অতীতে এসব বিধান কাগজে থাকলেও বাস্তবে কার্যকর হয়নি কেন? কেন নির্বাচন কমিশন বারবার শক্তিশালী পক্ষের কাছে নতি স্বীকার করেছে?
এবার সংশোধিত আরপিওতে আদালত ঘোষিত পলাতক বা ফেরারি আসামিদের প্রার্থী হওয়ার অযোগ্য ঘোষণা করা হয়েছে। এটি নিঃসন্দেহে একটি সঠিক ও সময়োপযোগী সিদ্ধান্ত। তবে এটিকে শুধু কাগুজে সংস্কার হিসেবে রেখে দিলে চলবে না। অতীতে দেখা গেছে, গুরুতর ফৌজদারি মামলায় অভিযুক্ত কিংবা সাজাপ্রাপ্ত ব্যক্তিরাও রাজনৈতিক পরিচয়ের জোরে নির্বাচনে অংশ নিয়েছেন এবং সংসদে বসে আইনের ঊর্ধ্বে অবস্থান করেছেন। এই সংস্কৃতি যদি এবারও বহাল থাকে, তাহলে আইন সংশোধনের সব প্রচেষ্টা অর্থহীন হয়ে যাবে।
আরও উদ্বেগের বিষয় হলো- শিক্ষা প্রতিষ্ঠান, বিশেষ করে স্কুল–কলেজের ব্যবস্থাপনা কমিটিকে রাজনৈতিক ক্ষমতার হাতিয়ার হিসেবে ব্যবহারের দীর্ঘদিনের প্রবণতা। সংশোধিত আইনে এসব প্রতিষ্ঠানের ব্যবস্থাপনা কমিটির সভাপতি বা গুরুত্বপূর্ণ পদধারীদের প্রার্থী হওয়ার অযোগ্য ঘোষণা একটি ইতিবাচক পদক্ষেপ। কিন্তু প্রশ্ন থেকেই যায়- এই বিধান কি সব দলের ক্ষেত্রেই সমানভাবে প্রয়োগ হবে, নাকি আবারও প্রভাবশালীদের জন্য ‘বিশেষ বিবেচনা’ থাকবে?
ভোটাধিকার প্রসঙ্গেও দ্বৈত মানদণ্ডের ইতিহাস বাংলাদেশের রাজনীতিতে নতুন নয়। আইন অনুযায়ী, ১৮ বছর বা তার বেশি বয়সী এবং ভোটার তালিকাভুক্ত প্রত্যেক নাগরিকের ভোট দেওয়ার অধিকার রয়েছে। এমনকি কারাবন্দিদের পোস্টাল ব্যালটে ভোট দেওয়ার সুযোগ দেওয়া একটি ইতিবাচক সিদ্ধান্ত। কিন্তু ভোটাধিকার নিশ্চিত করার আসল পরীক্ষা হয় ভোটকেন্দ্রে- যেখানে ভোটার নির্বিঘ্নে ভোট দিতে পারেন কি না, সেটিই মূল প্রশ্ন।
গত তিনটি জাতীয় নির্বাচনে ভোটাধিকার কাগজে থাকলেও বাস্তবে তা অনেক ক্ষেত্রেই ছিল অনুপস্থিত। কেন্দ্র দখল, আগাম ব্যালট ভর্তি, ভোটারদের কেন্দ্রে যেতে নিরুৎসাহিত করা- এসব অভিযোগ নতুন নয়। ফলে শুধু ভোটার তালিকা হালনাগাদ বা আইনি বিধান তুলে ধরলেই ভোটাধিকার নিশ্চিত হয় না।
ভোটাধিকার হারানোর ক্ষেত্রেও আইন কঠোর। মানসিক ভারসাম্যহীন ঘোষণা, দেউলিয়া অবস্থা, স্বেচ্ছায় বিদেশি নাগরিকত্ব গ্রহণ কিংবা আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইব্যুনালে দণ্ডিত হলে ভোটাধিকার বাতিল হয়। সাম্প্রতিক সময়ে আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইব্যুনালের রায় ও বিচারপ্রক্রিয়া নতুন করে বিতর্ক তৈরি করেছে। তবে এখানে আবেগ বা রাজনৈতিক অবস্থান নয়, আইনই শেষ কথা হওয়া উচিত। আইন যদি এক পক্ষের জন্য প্রযোজ্য হয়, তবে তা সবার জন্যই প্রযোজ্য হতে হবে।
প্রবাসী বাংলাদেশিদের ভোটাধিকার নিশ্চিত করার উদ্যোগ প্রশংসনীয়। দীর্ঘদিন ধরে বৈদেশিক আয়ে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখা এই জনগোষ্ঠী রাষ্ট্রের রাজনৈতিক সিদ্ধান্ত গ্রহণে অংশগ্রহণের সুযোগ পাবে- এটি ইতিবাচক। তবে দ্বৈত নাগরিকত্বের প্রশ্নে আইন স্পষ্ট। দ্বৈত নাগরিকরা ভোট দিতে পারবেন, কিন্তু সংসদ নির্বাচনে প্রার্থী হতে পারবেন না। এই বিধান বাস্তবায়নে অতীতে গড়িমসি ও রাজনৈতিক চাপের নজির রয়েছে। এবার সেই সুযোগ বন্ধ করতে হবে।
সবশেষে বলা যায়, ত্রয়োদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচন আইন, সংবিধান ও প্রতিষ্ঠানগুলোর জন্য একটি কঠিন পরীক্ষা। নির্বাচন কমিশনের সামনে এখন আর কোনো অজুহাত নেই। আইনি কাঠামো বিদ্যমান, বিধান স্পষ্ট। এখন দরকার কেবল নিরপেক্ষতা, দৃঢ়তা এবং রাজনৈতিক চাপ উপেক্ষা করার সক্ষমতা।
যদি এই নির্বাচনেও যোগ্যতা-অযোগ্যতার প্রশ্নে আপস করা হয়, যদি প্রভাবশালীদের জন্য আইন নমনীয় আর সাধারণ নাগরিকের জন্য কঠোর থাকে, তবে গণঅভ্যুত্থানের মাধ্যমে যে পরিবর্তনের আশা তৈরি হয়েছে, তা চূড়ান্তভাবে ভেঙে পড়বে। তখন প্রশ্ন উঠবে- এই নির্বাচন আদৌ গণতন্ত্রের পথে অগ্রগতি, না কি পুরোনো ছাড়ের সংস্কৃতির আরেকটি অধ্যায়।
ড. এ জেড এম মাইনুল ইসলাম পলাশ
লেখক সাংবাদিক কলামিস্ট ও মানবাধিকার কর্মী
