২০২৪ সালের ৫ আগস্টের পর বাংলাদেশে সাংবাদিকতার স্বাধীনতা চরম সংকটে পড়েছে। স্বৈরাচার পতনের পর এক বছর পেরিয়ে গেলেও ভয়ের বাতাবরণ, রাষ্ট্রীয় চাপ ও আইনি নিপীড়ন যেন আগের চেয়ে আরও সুসংগঠিত ও নিয়মিত।
আইনি নিপীড়ন ও দমনযন্ত্র
সাংবাদিকদের বিরুদ্ধে দুর্বল ভিত্তিতে ‘হত্যাচেষ্টা’ ও ‘অপরাধমূলক’ মামলা দায়েরের প্রবণতা উদ্বেগজনকভাবে বেড়েছে। এপ্রিল ২০২৫ পর্যন্ত প্রায় ২৬৬ জন, যার মধ্যে ২৫ জন সাংবাদিক, এমন মামলার শিকার হয়েছেন।
তথ্য মন্ত্রণালয় প্রেস অ্যাক্রেডিটেশন বাতিল করেছে ১৬৭ জন সাংবাদিকের, যাদের বিরুদ্ধে স্বাধীন প্রতিবেদন বা সরকারবিরোধী অবস্থান নেয়ার অভিযোগ ছিল।
হামলা, ভয় ও নিরাপত্তাহীনতা
আইন ও সালিশ কেন্দ্র (আসক) জানায়, ২০২৫ সালের প্রথম দুই মাসেই সাংবাদিকদের বিরুদ্ধে ৬২টি নিপীড়নের ঘটনা ঘটেছে। এর মধ্যে ২৫টি শারীরিক হামলা, আর ৫টি মামলা অন্তর্ভুক্ত।
"রিপোর্টার্স উইদআউট বর্ডারস (RSF)" তথ্য অনুযায়ী, সাংবাদিকদের ওপর সশস্ত্র গোষ্ঠী ও রাজনৈতিক কর্মীদের হামলা বাড়ছে।
পরিচিত সাংবাদিকদের হয়রানি
জনপ্রিয় সাংবাদিক ফারজানা রুপা ও তার স্বামীর বিরুদ্ধে দায়ের হওয়া 'হত্যাচেষ্টা' মামলাকে বিশ্লেষকরা রাজনৈতিক প্রতিহিংসার অংশ বলেই মনে করছেন। তাঁরা এখনো রিমান্ডে।
সাংবাদিক শ্যামল দত্ত, যিনি দীর্ঘদিন নিরপেক্ষতা বজায় রেখে কাজ করেছেন, তাঁকেও 'মানবতাবিরোধী অপরাধে' অভিযুক্ত করে আটক রাখা হয়েছে।
আইন ও ডিজিটাল নিপীড়ন
সাইবার সিকিউরিটি অ্যাক্ট (CSA)–এর নামে মতপ্রকাশের স্বাধীনতা খর্ব করা হচ্ছে। ‘ডিজিটাল নিরাপত্তা আইন’ এখনো দমনমূলক হাতিয়ার হিসেবে ব্যবহৃত হচ্ছে। এসব আইন অর্ধ-সংবিধানিক হয়ে ওঠায় রাষ্ট্রীয় ক্ষমতা অপব্যবহারের পথ উন্মুক্ত হয়েছে।
সম্পাদকীয় মূল্যায়ন
এ অবস্থা দেশের গণতন্ত্র ও গণমাধ্যমের মর্যাদার জন্য ভয়াবহ হুমকি। সাংবাদিকরা এখন জনস্বার্থে তথ্য প্রকাশ করতে গিয়ে নিজেই হয়রানির শিকার হচ্ছেন। এটি শুধু ব্যক্তি নয়, পুরো রাষ্ট্রযন্ত্রকে সংকটে ফেলে দিচ্ছে।
করণীয়: এখনই প্রয়োজন এক সমন্বিত প্রতিবাদ
✅ ভিত্তিহীন মামলা প্রত্যাহার ও মুক্তি: সাংবাদিকদের বিরুদ্ধে দায়েরকৃত রাজনৈতিক উদ্দেশ্যপ্রণোদিত মামলা অবিলম্বে প্রত্যাহার করতে হবে।
✅ আইন সংস্কার: CSA ও DSA–এর ব্যবহার সীমিত করতে হবে। একটি নিরপেক্ষ স্বাধীন রিভিউ বোর্ড গঠন করতে হবে।
✅ নিরাপত্তা নিশ্চয়তা: সাংবাদিকদের পেশাগত নিরাপত্তা দিতে হবে। বিশেষত, মাঠে কাজের সময় প্রশাসনিক সহায়তা ও সুরক্ষা নিশ্চিত করতে হবে।
✅ আন্তর্জাতিক সংহতি: CPJ, RSF, Article 19–এর মত আন্তর্জাতিক সংগঠনগুলোর সহায়তা নিয়ে একটি সার্বজনীন উদ্যোগ শুরু করা জরুরি।
উপসংহার:
৫ আগস্টের পর সাংবাদিকতা যেন ‘অঘোষিত অপরাধে’ পরিণত হয়েছে। তথ্য জানার ও জানানোর যে পবিত্র দায়িত্ব, তা আজ হুমকির মুখে।
"সাংবাদিকতা অপরাধ নয়"—এই সত্য প্রতিষ্ঠায় রাষ্ট্র, নাগরিক সমাজ ও আন্তর্জাতিক মহলের সবাইকে ঐক্যবদ্ধভাবে এগিয়ে আসতে হবে।