অন্তর্বর্তী সরকারের প্রধান উপদেষ্টা ড. মুহাম্মদ ইউনূস মঙ্গলবার (৫ আগস্ট) জাতীয় সংসদ ভবনের দক্ষিণ প্লাজায় ‘জুলাই ঘোষণাপত্র’ পাঠ করেন।
ঘোষণাপত্রে স্থান পেয়েছে মোট ২৮টি দফা, যেখানে ১৯৭১ সালের স্বাধীনতা সংগ্রাম থেকে শুরু করে ২০২৪ সালের জুলাই আন্দোলনের ইতিহাস ও প্রেক্ষাপট অন্তর্ভুক্ত হয়েছে।
ঘোষণাপত্র পাঠের সময় ড. ইউনূসের পাশে বিএনপির মহাসচিব মির্জা ফখরুল ইসলাম আলমগীর, জামায়াতে ইসলামীর সেক্রেটারি জেনারেল মিয়া গোলাম পরওয়ার, এনসিপি আহ্বায়ক নাহিদ ইসলাম এবং নাগরিক ঐক্যের সভাপতি মাহমুদুর রহমান মান্নাসহ বিভিন্ন রাজনৈতিক দলের শীর্ষ নেতারা উপস্থিত ছিলেন।
অনুষ্ঠান শুরু হয় জাতীয় সঙ্গীত পরিবেশনের মাধ্যমে, এরপর এক মিনিট নীরবতা পালন করা হয়। ঘোষণাপত্র পাঠের সময় বৃষ্টি পড়তে শুরু করলে ড. ইউনূস বলেন, “আমাদের জন্য রহমত বর্ষিত হচ্ছে, আল্লাহর রহমত নিয়েই আমি এই ঘোষণাপত্র পাঠ করবো…” এরপর তিনি পাঠ শুরু করেন।
জুলাই ঘোষণাপত্রে যা রয়েছে
১। যেহেতু উপনিবেশ বিরোধী দীর্ঘ সংগ্রামের ধারাবাহিকতায় এই ভূখণ্ডের মানুষ পাকিস্তানের ২৩ বছরের শোষণ-বঞ্চনার বিরুদ্ধে দাঁড়িয়ে, গণহত্যার প্রতিবাদে ১৯৭১ সালের ২৬ মার্চ স্বাধীনতার ঘোষণা দিয়ে রক্তক্ষয়ী মুক্তিযুদ্ধের মাধ্যমে বাংলাদেশ প্রতিষ্ঠা করেছিল;
এবং
২। যেহেতু বাংলাদেশের জনগণ স্বাধীনতার ঘোষণাপত্রে উল্লিখিত সাম্য, মানবিক মর্যাদা ও সামাজিক সুবিচারের ভিত্তিতে গণতান্ত্রিক রাষ্ট্র গড়তে সর্বোচ্চ ত্যাগ স্বীকার করেছে;
এবং
৩। যেহেতু ১৯৭২ সালের সংবিধান প্রণয়নের দুর্বলতা ও অপপ্রয়োগের কারণে স্বাধীনতা-পরবর্তী আওয়ামী লীগ সরকার মুক্তিযুদ্ধের চেতনা পূরণে ব্যর্থ হয়ে গণতন্ত্র ও রাষ্ট্রীয় প্রতিষ্ঠানের কার্যকারিতা ক্ষুণ্ণ করেছিল;
এবং
৪। যেহেতু আওয়ামী লীগ সরকার একদলীয় বাকশাল শাসন চালু করে মতপ্রকাশ ও বিচার বিভাগের স্বাধীনতা হরণ করেছিল, যার ফলে ১৯৭৫ সালের ৭ নভেম্বর সিপাহী-জনতার বিপ্লব সংঘটিত হয়ে বহুদলীয় গণতন্ত্র পুনঃপ্রবর্তনের পথ তৈরি হয়;
এবং
৫। যেহেতু আশির দশকে দীর্ঘ আন্দোলনের মধ্য দিয়ে ১৯৯০ সালের গণঅভ্যুত্থান ঘটে এবং ১৯৯১ সালে সংসদীয় গণতন্ত্র ফিরে আসে;
এবং
৬। যেহেতু দেশি-বিদেশি চক্রান্তে গণতান্ত্রিক প্রক্রিয়া ব্যাহত হয়ে ১/১১-এর মাধ্যমে শেখ হাসিনার একচ্ছত্র ক্ষমতার পথ সুগম হয়;
এবং
৭। যেহেতু গত ১৬ বছরের ফ্যাসিবাদী শাসন কায়েমের জন্য সংবিধানে অবৈধ পরিবর্তন এনে একদলীয় আধিপত্য প্রতিষ্ঠা করা হয়;
এবং
৮। যেহেতু শেখ হাসিনা সরকারের দুঃশাসন, গুম-খুন, মতপ্রকাশের স্বাধীনতা হরণ এবং সাংবিধানিক প্রতিষ্ঠানের ধ্বংস সাধিত হয়েছে;
এবং
৯। যেহেতু এই সরকারের কর্মকাণ্ডে বাংলাদেশ আন্তর্জাতিক অঙ্গনে ব্যর্থ রাষ্ট্রের ভাবমূর্তি পায়;
এবং
১০। যেহেতু তথাকথিত উন্নয়নের আড়ালে সীমাহীন দুর্নীতি, ব্যাংক লুট, অর্থ পাচার এবং পরিবেশ ধ্বংস ঘটানো হয়েছে;
এবং
১১। যেহেতু ফ্যাসিবাদবিরোধী আন্দোলনে জনগণ দীর্ঘদিন জেল-জুলুম, গুম-খুনের শিকার হয়েছে;
এবং
১২। যেহেতু বিদেশি প্রভুত্ববিরোধী আন্দোলন আওয়ামী লীগ সরকার দমন করেছে;
এবং
১৩। যেহেতু ২০১৪, ২০১৮ ও ২০২৪ সালের নির্বাচনে ভোটাধিকার থেকে জনগণকে বঞ্চিত করা হয়েছে;
এবং
১৪। যেহেতু বিরোধী নেতা-কর্মীদের নির্যাতন, দলীয় নিয়োগ ও কোটাভিত্তিক বৈষম্যে ছাত্র-যুবকদের ক্ষোভ সৃষ্টি হয়েছে;
এবং
১৫। যেহেতু দীর্ঘদিনের নিপীড়ন জনরোষে পরিণত হয়ে আন্দোলন অব্যাহত থাকে;
এবং
১৬। যেহেতু কোটাবিরোধী ছাত্র আন্দোলনে বর্বর দমন-পীড়নে গণঅভ্যুত্থান ঘটে;
এবং
১৭। যেহেতু এই আন্দোলনে সর্বস্তরের মানুষ অংশ নেয় এবং প্রায় এক হাজার মানুষ নিহত হয়, অগণিত মানুষ আহত হয়;
এবং
১৮। যেহেতু অসহযোগ আন্দোলন ও ৫ আগস্ট লংমার্চের পর শেখ হাসিনা পদত্যাগ করে দেশত্যাগে বাধ্য হয়;
এবং
১৯। যেহেতু জনগণের সার্বভৌমত্ব রাজনৈতিক ও আইনি দিক থেকে যুক্তিসঙ্গত ও স্বীকৃত;
এবং
২০। যেহেতু দ্বাদশ সংসদ ভেঙে দিয়ে ৮ আগস্ট ড. মুহাম্মদ ইউনূসের নেতৃত্বে অন্তর্বর্তী সরকার গঠন হয়;
এবং
২১। যেহেতু জনগণ ফ্যাসিবাদ, বৈষম্য ও দুর্নীতিমুক্ত রাষ্ট্র চায়;
এবং
২২। সেহেতু জনগণ আইনের শাসন, সুষ্ঠু নির্বাচন ও গণতান্ত্রিক সংস্কার চায়;
এবং
২৩। সেহেতু ফ্যাসিবাদী সরকারের গুম-খুন, হত্যা ও দুর্নীতির বিচার দাবি করছে;
এবং
২৪। সেহেতু জুলাই গণঅভ্যুত্থানের শহীদদের জাতীয় বীর ঘোষণা ও আহতদের সুরক্ষা দেওয়া হবে;
এবং
২৫। সেহেতু অবাধ ও সুষ্ঠু নির্বাচনের মাধ্যমে সাংবিধানিক সংস্কার করে গণতান্ত্রিক রাষ্ট্র গড়ার অঙ্গীকার করা হলো;
এবং
২৬। সেহেতু পরিবেশ ও জলবায়ু সহিষ্ণু টেকসই উন্নয়ন নিশ্চিত করা হবে;
এবং
২৭। সেহেতু ছাত্র-গণঅভ্যুত্থান ২০২৪-এর রাষ্ট্রীয় স্বীকৃতি এবং ঘোষণাপত্র সংবিধানে অন্তর্ভুক্ত হবে;
এবং
২৮। ৫ আগস্ট ২০২৪-এর গণঅভ্যুত্থানে বিজয়ী জনগণের আকাঙ্ক্ষার প্রতিফলন হিসেবে এ ঘোষণাপত্র প্রণীত হলো।
আজকের খবর/ এম. এস. এইচ.