টেলিভিশন উপস্থাপক ও বিশ্লেষক জিল্লুর রহমান বলেছেন, অন্তর্বর্তী সরকারের যাত্রা শুরুর সময় যে ন্যায়বিচার, সংস্কার, আইনশৃঙ্খলা ও সংলাপভিত্তিক নৈতিক ম্যান্ডেট ছিল, সেখানে সবচেয়ে বড় ধস নেমেছে। এর ফলে রাজনীতিতে এক ধরনের বিশ্বাসশূন্যতা তৈরি হয়েছে, যা ডানপন্থী সংগঠনগুলোকে দ্রুত সংগঠিত হয়ে দৃশ্যমান হওয়ার সুযোগ করে দিয়েছে।
বৃহস্পতিবার (৩১ জুলাই) রাতে নিজের ইউটিউব চ্যানেলে এক বিশ্লেষণমূলক আলোচনায় তিনি এ মন্তব্য করেন।
জিল্লুর রহমান বলেন, “দ্রুত সিদ্ধান্ত নেওয়ার অক্ষমতা, নেওয়া সিদ্ধান্ত তড়িৎ বদলে ফেলা, সরকারের মধ্যে সরকারের ইঙ্গিত এবং আইনশৃঙ্খলাজনিত অস্থিরতা জনগণের আস্থাকে গভীরভাবে নাড়া দিয়েছে। রাজনীতিতে সবচেয়ে বড় ভ্যাকুয়াম হলো বিশ্বাসশূন্যতা। আর এই শূন্যতা ডানপন্থী শক্তিগুলোকেই জায়গা করে দিয়েছে।”
তিনি বলেন, “ডানপন্থীদের উত্থান কি সত্যি? না কি আমরা শুধু দৃশ্যমানতা দেখছি?” — এই প্রশ্ন এখন আলোচনার কেন্দ্রে। তার ব্যাখ্যায়, রাষ্ট্র ও সমাজে যে শূন্যতা তৈরি হয়েছে, তা-ই এই দৃশ্যমানতার জ্বালানি হিসেবে কাজ করছে। এটি এক ধরণের নতুন রাজনীতির গল্প বলছে, যেখানে ঐতিহ্যগত দলগুলো ধাক্কা খাচ্ছে আর ডানপন্থীরা সংগঠনের ধারাবাহিকতায় এগিয়ে যাচ্ছে।
তার মতে, যদিও ডানপন্থীরা এখন মাঠে সংগঠিত ও আলোচনাযোগ্য অবস্থানে এসেছে, কিন্তু ভোট, নীতিনির্ধারণ বা রাষ্ট্রযন্ত্রে স্থায়ী প্রভাব বিস্তারের জায়গায় তারা এখনো প্রবেশ করেনি। আমরা এখনো আছি এক “প্রাক-নির্বাচনী দরকষাকষির মৌসুমে”, যেখানে যার কণ্ঠ জোরালো, তার দাম আপাতত বেশি।
জিল্লুর রহমান বলেন, বর্তমান সময়ে সমাজে ধর্মীয় অনুভূতি একটি শক্তিশালী আবেগ। অর্থনৈতিক চাপ, বৈদেশিক অনিশ্চয়তা এবং রাজনৈতিক দুর্বলতা যখন বাড়ে, তখন মানুষ সরল নৈতিক বার্তার প্রতি বেশি সাড়া দেয়। “শালীনতা রক্ষা”, “সামাজিক শুদ্ধি” কিংবা “ধর্মীয় অনুশাসন”— এই ভাষাগুলো সহজবোধ্য এবং দ্রুত সংগঠনে রূপ নিতে পারে।
তিনি সতর্ক করেন, ধর্মীয় অনুশীলনকে নাগরিক অধিকারের বিরোধী রূপে প্রজেক্ট করার চেষ্টা করা হলে সেটি বিপজ্জনক হতে পারে। রমজানে দোকান বন্ধে জোরজবরদস্তি, নারী খেলোয়াড়দের বাধা দেওয়া, পোশাক নিয়ে সহিংসতা বা মাজার ভাঙচুরের মতো ঘটনাগুলো যদি নিয়মিত হয়, তাহলে রাষ্ট্রের নীরবতা বা অপ্রতিসম প্রতিক্রিয়াই তা উৎসাহিত করে।
চতুর্থ গুরুত্বপূর্ণ সূত্র হিসেবে জিল্লুর রহমান ভূরাজনীতির প্রসঙ্গ তোলেন। তিনি বলেন, “দক্ষিণ এশিয়ায় রক্ষণশীল রাজনীতির ঢেউ নতুন নয়। ভারত, পাকিস্তান, আফগানিস্তানের সাম্প্রতিক ঘটনাপ্রবাহের ছায়া বাংলাদেশেও এসে পড়েছে।”
তার মতে, বিদেশি দাতাগোষ্ঠী ও কূটনীতিকদের স্থিতিশীলতাকেন্দ্রিক নীতিমালা গণতন্ত্রের চেয়ে বেশি গুরুত্ব পাচ্ছে, যা ভিন্নধারার রাজনীতিকে প্রভাবিত করছে। সরকার যখন আন্তর্জাতিক আস্থা ধরে রাখতে “ছুঁচো মেরে হাতি মারার মতো প্রতিক্রিয়া” দেখায়, তখন একদিকে প্রতিক্রিয়াশীলতা বাড়ে, আবার অন্যদিকে মাঠে উদারতার নামে নতুন শক্তিগুলো প্রবেশাধিকার পায়।
জিল্লুর রহমানের বিশ্লেষণে স্পষ্ট, বর্তমান রাজনৈতিক বাস্তবতায় রাজনীতির কেন্দ্রে একটি বড় শূন্যতা তৈরি হয়েছে। ঐতিহ্যবাহী দলগুলোর দুর্বলতা, অন্তর্বর্তী সরকারের ব্যর্থতা এবং সমাজে সহজবোধ্য ধর্মীয় ভাষার চাহিদা—সব মিলিয়ে ডানপন্থী রাজনৈতিক শক্তিগুলো দৃশ্যমান হয়েছে। তবে এ দৃশ্যমানতা কি স্থায়ী প্রভাব ফেলবে, না কি এটি শুধু একটি সাংগঠনিক সুযোগের ফসল—তা সময়ই বলে দেবে।