দক্ষিণাঞ্চলের বরগুনা জেলায় চলতি বছর ডেঙ্গুর মারাত্মক বিস্তার উদ্বেগ তৈরি করেছে জনস্বাস্থ্যবিদ, চিকিৎসক, গবেষক এবং সংশ্লিষ্ট সরকারি বিভাগগুলোর মধ্যে। পরিস্থিতি মূল্যায়নে সরকারের রোগতত্ত্ব, রোগনিয়ন্ত্রণ ও গবেষণা ইনস্টিটিউট (আইইডিসিআর)–এর একটি গবেষক দল গত রোববার বরগুনা সফর করেছেন।
এরই মধ্যে প্রতিদিন বাড়ছে ডেঙ্গু আক্রান্ত রোগীর সংখ্যা। আক্রান্তদের প্রায় অর্ধেকের বেশি বরিশাল বিভাগে, আর এরও সিংহভাগ আক্রান্ত বরগুনা জেলায়।
গত ২৪ ঘণ্টায় (রোববার সকাল থেকে সোমবার সকাল পর্যন্ত) সারা দেশে ডেঙ্গুতে আক্রান্ত হয়েছেন ২৪৩ জন। এর মধ্যে বরিশাল বিভাগে ১১৯ জন এবং বরগুনায় আক্রান্ত ৬৫ জন।
বরগুনার অবস্থা শুধু সংখ্যায় সীমাবদ্ধ নয়—এমনটাই মনে করছেন জনস্বাস্থ্য বিশেষজ্ঞ ডা. বে-নজীর আহমেদ। তিনি বলেন, “এই পরিস্থিতি আমাদের ডেঙ্গু মোকাবিলার কৌশলগত দুর্বলতাও সামনে আনছে। আমরা বহু আগে থেকেই বলছিলাম—ডেঙ্গু শুধু রাজধানীভিত্তিক সমস্যা নয়; সারা দেশে ছড়িয়ে পড়ার আশঙ্কা আছে। এখন বাস্তবে তাই দেখা যাচ্ছে। বরগুনার অবস্থা ভবিষ্যতের একটি বড় সংকটের ইঙ্গিত দিচ্ছে।”
এই সংকট কতটা গুরুতর হতে পারে?
জবাবে বে-নজীর আহমেদ বলেন, ঢাকায় যেমন রোগ নিয়ন্ত্রণ শাখা, উন্নত হাসপাতাল, আইইডিসিআরের কার্যক্রম ও প্রশিক্ষিত জনবল রয়েছে, তেমন সুবিধা ঢাকার বাইরে নেই। বরগুনার মতো প্রত্যন্ত এলাকায় তা আরও দুর্বল। এইভাবে যদি দেশের গ্রামাঞ্চলে ডেঙ্গু ছড়িয়ে পড়ে, তাহলে পরিস্থিতি ভয়াবহ রূপ নিতে পারে।
এ বছর দেশে ডেঙ্গুতে মারা গেছেন ৩০ জন, যার মধ্যে বরগুনায় মৃত্যু হয়েছে ৬ জনের। অর্থাৎ, দেশের মোট ডেঙ্গু মৃত্যুর এক-পঞ্চমাংশ বরগুনায়।
ডেঙ্গুর এত দ্রুত বিস্তার কেন?
এই প্রশ্নে আইসিডিডিআরবির বিজ্ঞানী মোহাম্মদ শফিউল আলম মনে করেন, নতুন কোনো সেরোটাইপ সক্রিয় কি না, সেটি নিরূপণ করা এখন খুব জরুরি।
তবে সরকারের পক্ষ থেকে এই বিষয়ে তেমন উদ্যোগ দেখা যাচ্ছে না। আইইডিসিআরের পরিচালক অধ্যাপক তাহমিনা শিরিন জানান, “আমরা মূলত ঢাকার হাসপাতালগুলোর নমুনা পাই। তাই ঢাকার বাইরের নতুন সেরোটাইপ শনাক্ত করার কোনো কার্যকর ব্যবস্থা আমাদের হাতে নেই।”
ডেঙ্গুর চারটি সেরোটাইপ রয়েছে। গত বছর পর্যন্ত সেরোটাইপ-২ প্রাধান্যশীল ছিল। তবে বছরের শেষ দিকে সেরোটাইপ-৪–এর উপস্থিতিও দেখা গেছে। নতুন সেরোটাইপ উদ্ভব হলে আক্রান্তের সংখ্যা এবং মৃত্যুঝুঁকি—উভয়ই বাড়ে।
বরগুনা সদর হাসপাতালের চিত্রও উদ্বেগজনক।
২৫০ শয্যার এই হাসপাতালে ডেঙ্গুর জন্য বরাদ্দ রয়েছে মাত্র ৫০টি শয্যা। গতকাল রোগীর সংখ্যা ছিল প্রায় ২০০। একই সঙ্গে স্যালাইনের সংকট রয়েছে—এটি স্বীকার করেছেন জেলা সিভিল সার্জন মো. আবু ফাত্তাহ।
তাঁর কার্যালয়ের তথ্যমতে, স্যালাইন সংকটে পাশে দাঁড়িয়েছে দুটি স্থানীয় বেসরকারি সংস্থা। ডেঙ্গু বাড়ার কারণে ছয়জন নতুন চিকিৎসক হাসপাতালটিতে যোগ দিয়েছেন।
তবে চিকিৎসাসেবার বাইরে, হাসপাতালের পাশেই যত্রতত্র ডাবের খোসা ও পানিধারী পাত্র পড়ে থাকতে দেখা যাচ্ছে। শহরের অন্যান্য স্থানেও বর্জ্য ব্যবস্থাপনার ঘাটতি রয়েছে।
সঠিক বর্জ্য ব্যবস্থাপনা ছাড়া ডেঙ্গু নিয়ন্ত্রণ সম্ভব নয়, এমনটাই বলছেন বে-নজীর আহমেদ। তিনি আরও বলেন, “পৌরসভাসহ স্থানীয় সরকারি প্রতিষ্ঠানগুলো এখন জনপ্রতিনিধিশূন্য। এই প্রশাসনিক শূন্যতা পরিস্থিতিকে আরও জটিল করে তুলছে। ডেঙ্গু ইতোমধ্যে সারা দেশে ছড়িয়ে পড়েছে, কিন্তু ঢাকার বাইরে দেশের অধিকাংশ অঞ্চল একে প্রতিরোধে সম্পূর্ণ অপ্রস্তুত। ভয়াবহ সময় আসছে বলে আশঙ্কা করছি।